বিনোদন ডেস্ক || ভয়েজ অফ জাস্টিস

বাংলা গানের আকাশে অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে আলো ছড়িয়ে চলা কণ্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়াসমীন। প্রায় ছয় দশকের সংগীতভ্রমণ তাঁকে বানিয়েছে এক অনন্য কিংবদন্তি। অসুস্থতার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে খুব বেশি শোনা না গেলেও গতকাল রোববার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চে আবারও দেখা মিলল প্রাণচঞ্চল, উচ্ছল, চিরচেনা সাবিনা ইয়াসমীনের। রাষ্ট্রীয় সম্মাননা, প্রিয় গান আর শিল্পীসঙ্গীদের স্মৃতিচারণ—সব মিলিয়ে হয়ে উঠেছিল স্মরণীয় এক রাত।
প্রস্তুতির গল্প
এই আয়োজনের ব্যস্ততা শুরু হয় কয়েক দিন আগে। বুধবার একাডেমির মহড়াকক্ষে ১৬ সদস্যের যন্ত্রীদল নিয়ে মহড়ায় বসেন সাবিনা ইয়াসমীন। বাইরে থেকে ভেসে আসছিল তবলা, হারমোনিয়াম, গিটার, বেহালা আর কি–বোর্ডের সম্মিলিত সুর। মাঝখানে ছিলেন দেশের শ্রেষ্ঠতম এই কণ্ঠশিল্পী। এত বছরের অভিজ্ঞতার পরও তিনি কতটা যত্নশীল, তার প্রমাণ মিলল মহড়ার প্রতিটি মুহূর্তে। নিজেই জানালেন, এখনো যেকোনো গানের অনুষ্ঠান শুরুর আগে নিয়মিত মহড়া করেন।
অনুষ্ঠানের সূচনা
সন্ধ্যা ৭টা ২৭ মিনিটে অনুষ্ঠান শুরু হয়। প্রথমে প্রয়াত গবেষক ও রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমরকে স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর দেখানো হয় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় প্রযোজিত একটি সংক্ষিপ্ত প্রামাণ্যচিত্র, যেখানে সমসাময়িক শিল্পীরা তুলে ধরেন সাবিনা ইয়াসমীনের অবদান ও স্মৃতিচারণ।
রাষ্ট্রীয় সম্মাননা
শুরুতেই সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সম্মাননা দেওয়ার সিদ্ধান্ত থাকলেও পরে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের হাত থেকে উত্তরীয় ও ক্রেস্ট গ্রহণ করেন সাবিনা ইয়াসমীন। তিনি বলেন, “আজ যাঁকে সম্মান জানানো হচ্ছে, তিনি আমাদের গৌরব, তিনি কিংবদন্তি।” প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকেও জানানো হয় জন্মদিনের শুভেচ্ছা। প্রতিক্রিয়ায় শিল্পী কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং সবাইকে ধন্যবাদ জানান।
গানের আসর
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় অংশ ছিল গানের। একে একে ১০টি জনপ্রিয় গান পরিবেশন করেন সাবিনা ইয়াসমীন। ‘আমি রজনীগন্ধা’, ‘শত জনমের স্বপ্ন’, ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’, ‘শুধু গান গেয়ে পরিচয়’—এসব গান শুনে মুহূর্তেই ভেসে যায় শ্রোতারা। গানের ফাঁকে ফাঁকে শিল্পী ভাগ করে নেন নিজের অভিজ্ঞতা ও গল্প।
স্মৃতিচারণ ও বিশেষ মুহূর্ত
গানে বিরতি দিয়ে মঞ্চে উঠে আসেন সংগীতজগতের আরও বরেণ্য শিল্পীরা—খুরশীদ আলম, রফিকুল আলম, আবিদা সুলতানা, নকীব খান, ফেরদৌস আরা, পার্থ বড়ুয়া ও আগুন। তাঁরা শোনান নানা অজানা–অপ্রকাশিত স্মৃতি। সেই আবেগঘন মুহূর্তেই সাবিনা ইয়াসমীন পান ‘মহানায়ক বুলবুল আহমেদ স্মৃতি সম্মাননা ২০২৫’ পদক। পদকটি তুলে দেন প্রয়াত অভিনেতার স্ত্রী ডেইজি আহমেদ ও কন্যা ঐন্দ্রিলা। শুভেচ্ছা জানাতে উপস্থিত ছিলেন অভিনেত্রী নূতনও।
রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে শেষ গান ‘সে যে কেন এল না’ গেয়ে মঞ্চ মাতালেন সাবিনা ইয়াসমীন। শেষ গানে তাঁর সঙ্গে কণ্ঠ মেলান অন্য শিল্পীরাও। রাত ১০টার দিকে অনুষ্ঠান শেষ হলে শ্রোতারা ফিরে যান মনে রাখার মতো এক সন্ধ্যার স্মৃতি নিয়ে।
এক কিংবদন্তির যাত্রা
১৯৫৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর জন্ম নেওয়া সাবিনা ইয়াসমীন শৈশবেই সংগীতে প্রতিভার ছাপ রাখেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে অল পাকিস্তান স্কুল মিউজিক কম্পিটিশনে প্রথম পুরস্কার পান। ১৯৬২ সালে রবীন ঘোষের সুরে প্রথম রেকর্ডিং করেন। শিশুশিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার পর ১৯৬৭ সালে ‘আগুন নিয়ে খেলা’ ছবিতে করেন প্রথম প্লেব্যাক। এরপর দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ১৬ হাজারের বেশি গান রেকর্ড করেছেন। চলচ্চিত্রের গান, আধুনিক, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, গজল—সব ক্ষেত্রেই রেখেছেন স্বাক্ষর।
তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতেছেন সর্বাধিক ১৫ বার, যা দেশে একমাত্র রেকর্ড। পেয়েছেন একুশে পদক (১৯৮৪), স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৯৬) সহ দেশ-বিদেশের অসংখ্য সম্মাননা। ২০২০ সালে কবরী পরিচালিত ‘এই তুমি সেই তুমি’ চলচ্চিত্রে সর্বশেষ গান গাওয়ার পাশাপাশি প্রথমবার সুরকার হিসেবেও কাজ করেন।
সমাপ্তি
প্রায় ছয় দশক ধরে শ্রোতাদের হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়া সাবিনা ইয়াসমীন শুধু কণ্ঠশিল্পী নন, তিনি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের জীবন্ত অংশ। রাষ্ট্রীয় সম্মাননায় সিক্ত এই সন্ধ্যা প্রমাণ করল—সুরের জাদু কখনো ম্লান হয় না, বরং সময়ের সঙ্গে আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

