ঢাকা অফিস || ভয়েজ অফ জাস্টিস

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, জুলাই জাতীয় সনদে যে সংবিধান-সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো রাখা হয়েছে, সেগুলো সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, যদি আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে কোনো সমাধান চলে আসে, তাহলে বিএনপি খুশি হবে; কারণ এই অনিশ্চয়তা আর দীর্ঘদিন চালিয়ে রাখা সম্ভব নয়। গত বৃহস্পতিবার তিনি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের বৈঠকে এসব পর্যখ্যাপন করেন।
সালাহউদ্দিন আহমদের বক্তব্যের সংক্ষিপ্ত ও সুসজ্জিত সারমর্ম নিচে তুলে ধরা হলো:
তিনি বলেন, কিছু প্রস্তাব রয়েছে — যেমন গণপরিষদ গঠন — যেগুলো মূলত নতুন সংবিধান প্রণয়ন বা সংবিধানের বড় ধরনের পরিবর্তনের জন্য প্রযোজ্য। ইতিহাসে এই ধরনের উদাহরণ আছে; শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রের মতো যেখানে নির্বাচনের পরে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য গণপরিষদ কার্যকর ছিল এবং পরে সংবিধান গৃহীত হয়েছিল। এ ধরনের ‘কনস্টিটিউশন অ্যাসেম্বলি’ বা গণপরিষদ নির্মাণের প্রসঙ্গ উঠে আসলে তা গঠনের যথাযথ পরিস্থিতি যাচাই করা জরুরি।
দ্বিতীয়ত, তিনি ‘প্রভিশনাল কনস্টিটিউশনাল অর্ডার’ প্রস্তাবটির প্রশ্ন তোলেন — বলতে চান, কোর আইনি কাঠামো ও প্রক্রিয়া ছাড়া এই ধরনের প্রভিশনাল অর্ডার দিয়ে কীভাবে সংবিধান-সংশ্লিষ্ট পরিবর্তন আনা যাবে। বিচার বিভাগের (জুডিশিয়ারির) স্বাধীনতার প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, পার্লামেন্ট কোনো বিষয় বদলাতে পারে কিন্তু সেই পরিবর্তন যদি পরবর্তীতে সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ হয়, সেক্ষেত্রে আদালত সেটিকে অবৈধ বিবেচনা করে দিতে পারে। তাই যেকোনো বড় সিদ্ধান্তের আগে সম্ভাব্য আইনগত ফল ও বৈধতার প্রশ্নগুলো বিবেচনায় রাখা দরকার।
সালাহউদ্দিন আক্ষেপ করে বলেন, এখানে যে বিষয়গুলো আমরা বদলাতে চাই — বিশেষত সংবিধানের মূল কাঠামো বা ‘বেসিক স্ট্রাকচার’— সেগুলোতে শুধু পার্লামেন্টে অধিকারের কথা বলে সমাধান করা সহজ হবে না। তিনি উল্লেখ করেন, বেসিক স্ট্রাকচারের ক্ষেত্রে কিছু কিছু অনুচ্ছেদ এমন রয়েছে যেগুলো পরিবর্তনের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সতর্কতা ও কঠোরতা প্রয়োজন। এজন্য তিনি একটি প্রস্তাবও তুলে ধরেন — যেখানে কনস্টিটিউশনে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন পার্লামেন্টে পাশ হলেও প্রেসিডেন্টের স্বাক্ষরের আগে গণভোটের ব্যবস্থা রাখতে চাওয়া হয়েছে যাতে জনগণের সরাসরি অনুমোদন নিশ্চিত হয়।
তিনি আরও বলেন, জাতীয় ঐকমত্য যদি প্রকৃত অর্থে প্রতিষ্ঠা করা হয়, তখন সেটাকে কেবল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চুক্তি বা অঙ্গীকারের বাইরে একটি জাতীয় প্রতিশ্রুতি হিসেবে প্রকাশ করা উচিত — তা একটি আনুষ্ঠানিক ডকুমেন্টে রূপ দেয়া ও জনগণের সামনে প্রকাশ করা দরকার। এরপরই প্রতিটি দলের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে সেই অঙ্গীকারকে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে, যাতে ভবিষ্যতের সংসদে এর বাস্তবায়ন টেকসইভাবে প্রাধান্য পায়। তবে এইসব অঙ্গীকারের বাস্তবিক গ্যারান্টি কী হবে — সেটাই মূল প্রশ্ন, এবং এই প্রশ্নের এখনও পরিস্কার উত্তর নেই।
বক্তব্যের একাংশে তিনি সংstitutional continuity বা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার গুরুত্বেও জোর দেন। যদি কেউ দাবি করেন যে বর্তমান সংবিধান স্থিত নেই বা ধারাবাহিকতা ভাঙা হয়েছে, তাহলে সেক্ষেত্রে পুরো রাজনৈতিক ও আইনি কাঠামো অস্থিতিশীলতার মধ্যে পড়ে যাবে। ফলে প্রথমেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে — আমরা ধারাবাহিকতা ধরে রাখছি না কি ভাঙাগড়ার মধ্যে চলে এসেছি। ধারাবাহিকতা থাকলে আলোচনা চালানো সম্ভব, অন্যথা নানা আইনি ও সাংবিধানিক জটিলতা তৈরি হবে।
সালাহউদ্দিন দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ইতিহাস উল্লেখ করে বলেন, গণ–অভ্যুত্থান বা গতকালের আন্দোলনের ফলে যে পরিবর্তন এসেছে, তা কিছু ক্ষেত্রে সরকারের পতন হিসেবে দেখা হয়েছে; তিনি তা ‘বিপ্লব’ বলেন না। তবে জনগণের অভিপ্রায় — ভোটের অধিকার ফিরে পাওয়া, বৈষম্যহীন সামাজিক ব্যবস্থা, ও রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের দাবি — এগুলো স্পষ্টভাবে সামনে এসেছে। বিএনপি হিসেবে তারা বহু সংস্কারের পক্ষে ছিল এবং তাদের কিছু প্রস্তাব ইতোমধ্যে ঐকমত্য কমিশনেও উপস্থাপিত হয়েছে; তবে বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে সমস্যা রয়ে গেছে।
সংবিধান-সম্পর্কিত প্রস্তাব বাস্তবায়নে চারটি উপায় সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের মতামত এসেছে — অধ্যাদেশ, নির্বাহী আদেশ, গণভোট এবং বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ। এ প্রসঙ্গে তিনি মনে করান, যেসব প্রস্তাব সংবিধানকে স্পর্শ করে না, সেগুলো অন্তর্বর্তী সরকার অধ্যাদেশ বা নির্বাহী আদেশে করতে পারবে; তবে সংবিধানের মূল অনুচ্ছেদ, কাঠামো বা চরিত্র বদলানো হলে তা সহজ নয় এবং ব্যাপক আইনি প্রশ্ন উৎপন্ন করবে।
তার বক্তব্যে অতীতের ইতিহাসও টেনে বলা হয়েছে — ১৯৭১–৭২ সালের পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট আদেশ বা প্রভিশনাল অর্ডার প্রয়োগ ঘটেছে, কিন্তু সেগুলোর বৈধতা পরবর্তীতে পার্লামেন্টে আইনগতভাবে নিশ্চিত করা হয়েছিল। সেই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট স্মরণ করিয়ে তিনি প্রশ্ন উত্থাপন করেন — আজকের পরিবেশে কি আবার সেই রকম পরিস্থিতি তৈরি করা যুক্তিসঙ্গত ও বৈধ হবে?
সালাহউদ্দিন বলেন, এই আলোচনা ও প্রস্তাবগুলোর একাংশে যদি আমরা যথাযথভাবে সমাধান না পাই, তাহলে শেষ পর্যন্ত আইনগত প্রশ্ন ও বিচারিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে — যা রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার পক্ষে ভালো হবে না। তাই তিনি জাতীয় সম্মতি, পরিষ্কার প্রক্রিয়া ও জনসম্মতিক্রমে এগোবার পক্ষে আরও জোরদার আহ্বান জানান।
শেষে তিনি পুনরায় বলেন — যদি আলোচনা-পর্বে সব পক্ষই এমন কোন স্থানে যেতে পারে যেখানে পুরোদমে সমঝোতা সম্ভব, তাহলে সেটাই চূড়ান্ত উপায়। এই অনিশ্চয়তা আরও বেশি দিন টানা যাবে না; ফলে দ্রুত সম্মানজনক একটা সমাধান খুঁজে নেওয়া দরকার।

