ঢাকা অফিস || ভয়েজ অফ জাস্টিস

ডাকসু নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিয়ে শুরু থেকেই দ্বিধা ও অনিশ্চয়তায় ছিল জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠনগুলো যখন ক্যাম্পাসজুড়ে নানা তৎপরতায় ব্যস্ত, তখনো ছাত্রদল তাদের প্যানেল ঘোষণা করতে পারেনি। ভিপি পদে কে প্রার্থী হবেন, সেটি নিয়েও কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে ছিল ধোঁয়াশা। শেষ পর্যন্ত ভোটের মাত্র ২০ দিন আগে তারা প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করে।
প্রস্তুতির ঘাটতি, পরিকল্পনার অভাব এবং প্রচারণায় সমন্বয়হীনতা—সব মিলিয়ে ছাত্রদলের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে। জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর শিবির তাদের নেতাদের সামনে আনার চেষ্টা করলেও ছাত্রদল তেমন কোনো মুখ শিক্ষার্থীদের কাছে উপস্থাপন করতে পারেনি। এমনকি ভোটের তফসিল ঘোষণার পরও ভিপি প্রার্থী নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটেনি।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও স্বীকার করেছেন, ডাকসু নির্বাচন নিয়ে শুরু থেকেই কার্যকর আলোচনা বা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হয়নি। তাঁরা বলেন, বিষয়টিকে যতটা গুরুত্ব দেওয়া দরকার ছিল, নানা কারণে তা দেওয়া যায়নি। ফলে প্রার্থী চূড়ান্ত করা ও কর্মকৌশল ঠিক করতে দেরি হয়ে গেছে।
তবে তাদের মতে, আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামলে ক্যাম্পাসে ছাত্রদলকে প্রকাশ্যে কোনো কার্যক্রম চালাতে দেওয়া হয়নি। বারবার হামলার শিকার হয়েছেন নেতা-কর্মীরা। বিপরীতে অন্য একটি সংগঠনের অনেক কর্মী গোপনে ক্যাম্পাসে সক্রিয় থেকেছে এবং সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালিয়েছে।
প্রচারণায় দুর্বলতা ও পরিচিতির ঘাটতি
প্রার্থী ঘোষণায় দেরি হওয়ার পাশাপাশি প্রচারণাতেও ছাত্রদল কোনো চমক দেখাতে পারেনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের প্রচার শিক্ষার্থীদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠেনি। আবাসিক হলে সাংগঠনিক ভিত্তি দুর্বল থাকায় সেখানেও সমর্থন জোগাড় করতে ব্যর্থ হয়। তাছাড়া অনেক প্রার্থী শিক্ষার্থীদের কাছে অপরিচিত ছিলেন।
দীর্ঘ অনুপস্থিতি ও অপপ্রচার
প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলা ছাত্রদলের বিভিন্ন স্তরের ১০ জন নেতা-কর্মীর মতে, দীর্ঘ অনুপস্থিতির কারণে শিক্ষার্থীদের আস্থা অর্জন করতে পারেনি সংগঠনটি। নতুন কর্মী গড়ে ওঠেনি, নেতৃত্বেও ছিল সংকট। ফলে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে সম্পর্ক দুর্বল থেকে যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক এক নেতা বলেন, ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ থাকলেও সক্রিয় ও দায়িত্বশীল সংগঠন হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি ছাত্রদল। বিপরীতে শিবির পরিকল্পনা ও লক্ষ্য নিয়ে সক্রিয় থেকেছে এবং তার সুফলও পেয়েছে।
তাঁদের অভিযোগ, আবাসিক হলে কর্মসূচি পালনে বাধা দেওয়া হয়েছে। হল কমিটি ঘোষণার পর ছাত্রদলের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে ‘মব’ তৈরি করা হয়। পাশাপাশি প্রচার চালানো হয় যে, ছাত্রদল ক্ষমতায় এলে আবারো ‘গণরুম-গেস্টরুম সংস্কৃতি’ ফিরবে এবং শিক্ষার্থীদের জোর করে মিছিলে নিয়ে যাওয়া হবে।
নেতিবাচক প্রভাব
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ফজলুর রহমানের একটি বিতর্কিত মন্তব্য নির্বাচনের আগে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। এর নেতিবাচক প্রভাবও ফলাফলে পড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
তাছাড়া জুলাই-পরবর্তী সময়ে বিএনপির কিছু নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে খুন, চাঁদাবাজি ও দখলবাজির মতো অভিযোগ শিক্ষার্থীদের মনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করেছে। যদিও এসব ঘটনায় দলের পক্ষ থেকে কিছু সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল।
নির্বাচনের ফলাফল
৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতৃত্বাধীন ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট ভিপি, জিএস, এজিএসসহ ২৮টির মধ্যে ২৩টি পদে জয়ী হয়েছে। একটিও পদ পায়নি ছাত্রদল।
বিশ্লেষকদের মত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান মনে করেন, শিবির এক বছর ধরেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছে। তাদের প্রার্থী আগে থেকেই ঠিক ছিল এবং তারা নিয়মিত প্রচারণা চালিয়েছে। অন্যদিকে ছাত্রদল মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময়ও নিশ্চিত ছিল না কারা প্রার্থী হবেন।
তিনি বলেন, ছাত্রদলের প্রস্তুতিতে বড় ঘাটতি ছিল। জামায়াত তাদের ছাত্রসংগঠনকে পূর্ণ সমর্থন দিলেও বিএনপি কি তাদের সর্বশক্তি ব্যবহার করেছে, সে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান আরও মনে করেন, শিক্ষার্থীরা শুধু প্রার্থীদের নয়, জুলাই-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন দলের ভূমিকাও বিবেচনায় নিয়ে ভোট দিয়েছেন।

